২৪খবরবিডি: 'বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গ্রেপ্তাররা হলেন— চক্রের মূলহোতা মাহবুব উল হাসান (৫০) ও তার সহযোগী মাহমুদ করিম (৩৬)।'
'বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫২১টি পাসপোর্ট, বিদেশে চাকরির জন্য তৈরি ভুয়া কোর্সের ৬৫টি সনদ, ৩০০টি ভুয়া মেডিকেল সনদ, ২২৫টি ভুয়া কোভিড টিকা সনদ জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া সৌদি, ইরাক, কুয়েত, দুবাই, রোমানিয়া, কানাডা ও কম্বোডিয়ায় চাকরির ভুয়া চুক্তিপত্র, টাকা নেওয়ার রেজিস্টার, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদ, রোমানিয়ার জাল ভিসা, জাল কাগজপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত কম্পিউটার, স্ক্যানার ও প্রিন্টার জব্দ করা হয়। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতারক চক্রটির দুজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে শুক্রবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ। গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত চক্রটি বিভিন্ন অসহায় ও দরিদ্র লোকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রের মূলহোতা মাহবুব উল হাসান এবং তার প্রধান সহযোগী মাহমুদ করিম। তারা বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দালালের মাধ্যমে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক লোকজনের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। এভাবে তারা গত দুই বছরে ৫২১টি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন।'
'তিনি বলেন, বিদেশ যেতে ইচ্ছুক লোকজনকে টার্গেট করে অগ্রিম অর্থ আদায় করত চক্রটি। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে ইচ্ছুকদের কাছ থেকে ২-৩ লাখ টাকা এবং ইউরোপে যেতে ইচ্ছুকদের কাছ থেকে ৬-৭ লাখ টাকা করে জমা নেন চক্রের সদস্যরা। এরপর বিভিন্ন কোম্পানির নামে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র, ভুয়া মেডিকেল সনদসহ বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে তারা ভুক্তভোগীদের বিদেশে পাঠানোর নিশ্চয়তা দেন। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার কোনো অগ্রগতি না দেখে টাকা ফেরত চান ভুক্তভোগীরা। তবে তারা টাকা ফেরত দেননি। তিনি আরও বলেন, গত দুই বছরে পাসপোর্ট এবং অর্থ জমা দেওয়া কোনো ভুক্তভোগীকে তারা বিদেশে পাঠাতে পারেননি। তবুও তারা নিয়মিতভাবে দালালদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার লোকজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় অব্যাহত রাখেন। আদায় করা অর্থসহ গ্রেপ্তাররা বিদেশে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করেন। মাহবুব এ পর্যন্ত সংগ্রহ করা কোনো পাসপোর্ট কোনো এজেন্সির কাছে জমা দেননি।'
'র্যাব-৩ এর সিও বলেন, গ্রেপ্তার মাহবুব ২০০০ সাল থেকে সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের সদস্য। তিনি উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রতারণার মাধ্যমে কিছু লোক পাঠান। তাদের দেখে প্রলোভনে পড়ে ভুক্তভোগী ও অভিভাবকরা রাজি হলে প্রথমে পাসপোর্ট এবং প্রাথমিক খরচ বাবদ এক-দুই লাখ টাকা আদায় করেন। পরে দালালের মাধ্যমে কল দিয়ে ভুক্তভোগীদের আশ্বস্ত করতেন যে, মাহবুবের মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে তারা ভালো আছেন এবং অনেক অর্থ উপার্জন করছেন। বিদেশ থেকে কল পেয়ে ভুক্তভোগীরা আরও আগ্রহী হন। এই সুযোগে চক্রটি তাদের কাছ থেকে ধাপে ধাপে টাকা হাতিয়ে নিতে থাকে।'
'র্যাব জানায়, চক্রটি ফ্লাইটের আগে ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট, ভিসা কিংবা টিকিট হস্তান্তর করত না। কখনো কখনো মাহবুব প্রতারণার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাজের বদলে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে পাঠাতেন। সেখানে গিয়ে চক্রের সদস্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা ছাড়া ভুক্তভোগীদের কিছুই করার থাকত না। বিদেশে পৌঁছার পর সেখানকার এজেন্টের মাধ্যমে আবারো প্রতারিত হতেন ভুক্তভোগীরা। তাদের কাজের নামে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে বন্দি করে রাখা হতো।
সংঘবদ্ধ চক্রটি বিদেশে পাঠানোর নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে: র্যাব
এরপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। এ সময়ে মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের অপেক্ষা করতে বলেন এবং কিছুদিন পর কোম্পানি চালু হবে বলে জানান। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকে নিজেদের চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দেশে ফিরে এলে মাহবুব অভিভাবক ও উল্টো দোষারোপ করতেন। তিনি বলতেন, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে তারা কাজের সুযোগ পেতেন। করোনার আগ পর্যন্ত মালয়েশিয়া, দুবাই ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভুক্তভোগীদের পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন মাহবুব।'
'র্যাব-৩ সিও বলেন, গ্রেপ্তার মাহবুব ও তার সহযোগীর ট্রাভেল এজেন্সি বা রিক্রুটিং এজেন্সি পরিচালনার কোনো লাইসেন্স নেই। স্বল্প সময়ে, বিনাশ্রমে অধিক লাভ বা অর্থ উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ভুক্তভোগীরা বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার এবং আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হলেও তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার মাহবুব উল হাসান এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ১৯৯৩ সালে মালয়েশিয়ায় যান। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে কৃষিকাজ শুরু করেন। স্বল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় অবৈধভাবে ২০০০ সাল থেকে এক এজেন্সির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানো শুরু করেন তিনি। ওই এজেন্সি থেকে চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পাওয়ায় ২০১৪ সালে আরেকটি এজেন্সির মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তার পাঠানো প্রত্যেকেই বিদেশে গিয়ে কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এরপর কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য ছাড়াই কোটিপতি হওয়ার আশায় নিজেই অবৈধভাবে একটি অফিস খুলে মিথ্যা প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।'